-->

পুরাণে সময়ের গণনা: যুগ, মন্বন্তর ও কল্প - মহাবিশ্বের সময়চক্রের রহস্য

 হিন্দু পুরাণ শুধুমাত্র ধর্মীয় কাহিনী বা দেবদেবীর লীলার গাথা নয়, বরং এটি সময়, মহাবিশ্ব এবং জীবনের চক্রকে গভীরভাবে উপস্থাপন করে। পুরাণে সময়ের গণনা একটি জটিল এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বর্ণনা করা হয়েছে, যা যুগ, মন্বন্তর এবং কল্পের মতো ধারণার মাধ্যমে মহাবিশ্বের সময়চক্রকে ব্যাখ্যা করে। এই পোস্টে আমরা হিন্দু পুরাণে বর্ণিত সময়ের গণনা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।



১. যুগ: সময়ের চারটি পর্যায়

পুরাণ অনুসারে, সময় চারটি যুগে বিভক্ত: সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ এবং কলিযুগ। এই চার যুগ একটি চক্রাকার প্রক্রিয়ায় আবর্তিত হয়।

সত্যযুগ: 

সত্যযুগ হল সত্য, ধর্ম এবং ন্যায়ের যুগ। এই যুগে মানুষের আয়ু ছিল দীর্ঘ, এবং ধর্ম ও নৈতিকতা ছিল সর্বোচ্চ স্তরে। সত্যযুগের সময়কাল হল ১,৭২৮,০০০ বছর।

ত্রেতাযুগ:

 ত্রেতাযুগে ধর্ম ও নৈতিকতা কিছুটা হ্রাস পায়। এই যুগে যজ্ঞ ও তপস্যার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ত্রেতাযুগের সময়কাল হল ১,২৯৬,০০০ বছর।

দ্বাপরযুগ: 

দ্বাপরযুগে ধর্ম ও নৈতিকতা আরও হ্রাস পায়। এই যুগে মানুষের আয়ু কমে যায়, এবং দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বৃদ্ধি পায়। দ্বাপরযুগের সময়কাল হল ৮৬৪,০০০ বছর।

কলিযুগ: 

কলিযুগ হল বর্তমান যুগ, যেখানে ধর্ম ও নৈতিকতা সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে। এই যুগে মানুষের আয়ু খুবই কম, এবং অজ্ঞতা ও পাপ বৃদ্ধি পায়। কলিযুগের সময়কাল হল ৪৩২,০০০ বছর।

২. মন্বন্তর: মহাকালের একটি বৃহত্তর ইউনিট
মন্বন্তর হল সময়ের একটি বৃহত্তর ইউনিট, যা ৭১টি যুগের সমান। প্রতিটি মন্বন্তরে একজন মনু (মানবজাতির পিতা) এবং সাতজন সপ্তঋষি (মহান ঋষি) রয়েছেন।

মন্বন্তরের সময়কাল: একটি মন্বন্তরের সময়কাল হল ৩০৮,৪৪৮,০০০ বছর।

মনু ও সপ্তঋষি: প্রতিটি মন্বন্তরে একজন নতুন মনু এবং সাতজন সপ্তঋষি মানবজাতিকে পথনির্দেশনা দেন।

বর্তমান মন্বন্তর: আমরা বর্তমানে সপ্তম মন্বন্তরে রয়েছি, যার মনু হলেন বৈবস্বত মনু।

৩. কল্প: ব্রহ্মার এক দিন

কল্প হল সময়ের একটি বিশাল ইউনিট, যা ব্রহ্মার এক দিনের সমান। একটি কল্পে ১৪টি মন্বন্তর এবং ১,০০০টি যুগ রয়েছে।

কল্পের সময়কাল: একটি কল্পের সময়কাল হল ৪.৩২ বিলিয়ন বছর।

কল্পের শুরু ও শেষ: প্রতিটি কল্পের শুরুতে ব্রহ্মা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন এবং শেষে প্রলয় (ধ্বংস) ঘটে।

বর্তমান কল্প: আমরা বর্তমানে শ্বেতবরাহ কল্পে রয়েছি।

৪. মহাকাল: সময়ের সর্বোচ্চ ইউনিট
মহাকাল হল সময়ের সর্বোচ্চ ইউনিট, যা ব্রহ্মার জীবনকালের সমান। ব্রহ্মার জীবনকাল হল ১০০ বছর, যেখানে প্রতিটি বছর ৩৬০টি কল্পের সমান।

মহাকালের সময়কাল: একটি মহাকালের সময়কাল হল ৩১১,০৪০,০০০,০০০,০০০ বছর।

মহাকালের শেষ: ব্রহ্মার জীবনকাল শেষ হলে মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ ধ্বংস ঘটে এবং নতুন ব্রহ্মা দ্বারা নতুন সৃষ্টি শুরু হয়।

৫. পুরাণ ও আধুনিক বিজ্ঞানের সমান্তরাল

পুরাণে বর্ণিত সময়ের গণনা পদ্ধতি আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে আশ্চর্যরকমভাবে মিলে যায়। যেমন:

বিগ ব্যাং তত্ত্ব: পুরাণে বর্ণিত সৃষ্টি ও ধ্বংসের চক্র আধুনিক বিজ্ঞানের বিগ ব্যাং এবং বিগ ক্রাঞ্চ তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

মহাবিশ্বের বয়স: পুরাণে বর্ণিত কল্পের সময়কাল (৪.৩২ বিলিয়ন বছর) আধুনিক বিজ্ঞানে অনুমানকৃত মহাবিশ্বের বয়সের কাছাকাছি।

সময়ের আপেক্ষিকতা: পুরাণে সময়ের বিভিন্ন স্তরের বর্ণনা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সময়ের আপেক্ষিকতার ধারণার সাথে মিলে যায়।

উপসংহার:
হিন্দু পুরাণে সময়ের গণনা পদ্ধতি একটি গভীর এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে, যা মহাবিশ্বের সময়চক্রকে ব্যাখ্যা করে। যুগ, মন্বন্তর এবং কল্পের ধারণা আমাদের সময়, সৃষ্টি এবং ধ্বংসের চক্রকে বুঝতে সাহায্য করে। পুরাণের এই জ্ঞান আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং মহাবিশ্বের রহস্যকে আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে।

You May Like Also Also Like This

Post a Comment

0 Comments


Advertisement